কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে শাহনেওয়াজ নামে এক স্থানীয় দর্শনার্থীকে আটকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে কাছারি বাড়ির কাস্টোডিয়ান ও স্টাফদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার সূত্র ধরে পরে কাছারি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে স্থানীয় এক গ্রুপ। এরই প্রেক্ষিতে কাছারি বাড়িতে অনির্দিষ্টকালের জন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘটনায় শাহনেওয়াজ ও কাস্টোডিয়ান উভয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দু’টি মামলা করা হয়েছে। এই ঘটনার পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

 

পুলিশের সূত্রে জানা যায়, ঈদের পরদিন ৮ জুন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শাহনেওয়াজ হোসেন নামের এক দর্শনার্থী স্ত্রী সুইটি খাতুন ও ভাতিজাকে নিয়ে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি ঘুরতে আসেন। শাহনেওয়াজ স্থানীয় রূপপুর মহল্লার বাসিন্দা ও প্রবাসী। তিনি প্রবেশ মূল্য নিয়ে টিকেট নেন। কিন্তু মোটরসাইকেল পার্কিংয়ের জন্য টাকা নেওয়া হলেও তাকে কোনো টোকেন দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

 

শাহনেওয়াজ কাছারি বাড়ি পরিদর্শন শেষে বের হওয়ার সময় মোটরসাইকেলের টিকেট দেখতে চান মেইন গেইটে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। টিকেট দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় শাহনেওয়াজের সঙ্গে ওই কর্মচারীর কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

 

পরে কাস্টোডিয়ানসহ কাছারি বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীরা মিলে শাহনেওয়াজকে ধরে নিয়ে গিয়ে অফিসের মধ্যে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

 

সংবাদ পেয়ে শাহনেওয়াজের অভিভাবক এবং স্থানীয় বিএনপি নেতারা তাকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় শাহনেওয়াজ ওই দিন রাতেই শাহজাদপুর থানায় কাস্টডিয়ান হাবিবুর রহমান, কর্মচারী শরিফুজ্জামান সরকার, সিরাজুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান ও আব্দুল মমিনের নাম উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দেন।

 

অভিযোগ দেওয়া সত্ত্বেও দুই দিন পরও ওই ঘটনায় পুলিশ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে শাহজাদপুরের সর্বস্তরের জনতার ব্যানারে শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সামনে মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে বক্তারা রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির কর্মচারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

 

কিন্তু এ কর্মসূচি শেষে ৫০-৬০ বিক্ষুব্ধ জনতা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাছারি বাড়ি কাস্টডিয়ানের অফিস কক্ষ ও অডিটরিয়ামের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে চলে যায়। এ সময় সেখানকার দরজা, জানালা ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। এ সময় কাছারি বাড়ির পরিচালক সিরাজুল ইসলামকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।

 

খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মুশফিকুর রহমান। 

 

শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আছলাম আলী বলেন, “শাহনেওয়াজ নামের এক প্রবাসীকে নির্যাতনের অভিযোগে ঈদের দ্বিতীয় দিন রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির কাস্টডিয়ানসহ কয়েকজন কর্মচারীর নামে থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আজ হঠাৎ বিক্ষুব্ধরা কাছারিবাড়িতে হামলা চালিয়ে দরজা-জানালা ভাঙচুর করেছে। খবর পেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।” 

 

তিনি বলেন, “দর্শনার্থীদের মারধর এবং বিক্ষুব্ধ জনতার ভাঙচুর- উভয় ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

 

এ প্রসঙ্গে শাহনেওয়াজের ভাই সুমন আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, “প্রবাসী শাহনেওয়াজ ছুটিতে দেশে এসে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল রবীন্দ্র কাছারি বাড়িতে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করে কাস্টোডিয়ান ও স্টাফরা।” 

 

তিনি বলেন, “এই কাস্টোডিয়ান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দর্শনার্থীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করে আসছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দর্শনার্থী তাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছেন।”

 

তিনি আরও বলেন, “এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে। তবে কাছারি বাড়িতে হামলার সঙ্গে আমরা জড়িত নই।”

 

এদিকে, কাছারি বাড়িতে অনির্দিষ্টকালের জন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

 

বুধবার (১১ জুন) সকালে কাছারিবাড়ির কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

 

প্রবেশ নিষিদ্ধের একটি নোটিশ রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির মূল দরজায় টানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে আগত দর্শনার্থীদের ফিরে যেতে দেখা যায়।

 

ঈদের পরদিনের ঘটনাটিকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে মন্তব্য করে কাছারি বাড়ির কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বলেন, “অনিবার্য কারণবশত দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকবে এবং পুরো বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নজরদারিতে রয়েছে। ঈদের ছুটিতে এক দর্শনার্থীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার পর অডিটোরিয়াম ভাঙচুর ও মারধরের পর কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

 

কাছারি বাড়িতে হামলা চালিয়ে অডিটোরিয়াম ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে বুধবার (১১ জুন) দুপুরে শাহজাদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।

 

মামলার প্রসঙ্গে শাহজাদপুর ওসি আসলাম বলেন, “কাছারি বাড়িতে হামলা চালিয়ে অডিটোরিয়াম ভাঙচুর ও স্টাফদের মারধরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত পরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।”

 

এ প্রসঙ্গে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, “সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) শেখ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি বুধবার দুপুরে শাহজাদপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছেন। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।” 

 

তিনি বলেন, “তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এ ঘটনায় মামলা দায়েরের সিদ্বান্ত দেন। এরপরই কাছারি বাড়ির কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বাদি হয়ে মামলা করেন।”