সর্বশেষ
ইরান থেকে আবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ৩ জন নিহতের দাবি
সম্পূর্ণ নিউজ
খাদ্যাভ্যাসে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব। ছবি: প্রতীকী
যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদেরকে ‘খাওয়ার সমস্যায়’ ঠেলে দিচ্ছে
সোশ্যাল মিডিয়া রোগা হওয়ার প্রশংসা করে এবং খাবার ও পুষ্টি নিয়ে ভুল ও বিপজ্জনক পরামর্শ ছড়ায়। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সহজেই প্রভাবিত হওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসে মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
প্যারিস বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশেষ করে কিশোরী ও তরুণীরা অ্যানোরেক্সিয়া, বুলিমিয়া কিংবা অনিয়ন্ত্রিত খাওয়ার মতো রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ছেলেদের মধ্যেও এসব সমস্যা বাড়ছে।
খাবার খাওয়ার অভ্যাসজনিত কিছু রোগ:
অ্যানোরেক্সিয়া: অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা (Anorexia Nervosa) কম খাওয়ার রোগ। সাধারণত মেয়েদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় এই রোগ। এতে রোগীর খাওয়ার ইচ্ছা অস্বাভাবিক রকম কমে যায়। অল্পবয়স্ক মেয়েদের স্লিম হওয়ার বাসনা থেকে অনেক সময় এই সমস্যার শুরু। তবে অন্যান্য মানসিক চাপও থাকতে পারে, যেমন মোটা হয়ে গেলে লোকে কটূক্তি করবে। ফলে ধীরে ধীরে খাওয়ার ইচ্ছা কমতে থাকে, ওজন কমতে থাকে। তার সঙ্গে অপুষ্টিজনিত নানান সমস্যা দেখা দেয়।
কারও ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ শতাংশ কমে গেলে অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা হয়েছে ধরা যায়। এরা সর্বদা আতঙ্কে থাকে যে ওজন বেড়ে যাবে। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যায়াম করে।
বুলিমিয়া: বুলিমিয়া নারভোসা (Bulimia Nervosa) হল একটি মানসিক অবস্থা যেটি প্রথমে অতিরিক্ত খাবার খেয়ে নেওয়া এবং পরে সেটিকে শরীর থেকে বের করার জোরজবরদস্তি/অতিরিক্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। এটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই হয় কিন্তু কিশোরী মেয়েদের মধ্যে প্রায় সবচেয়ে বেশি ঘটে। ব্যক্তিটি যে কোনও সময়ে বিঞ্জ ইট (অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে খাবার আগ্রাসী হয়ে খেতে থাকে) করতে চাইতে পারেন এবং খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর অনুভূতি থাকে, তারপর খাওয়ার পথে বা পরে হঠাৎ লজ্জায় পড়েন; এই কারণে, ব্যক্তি খেয়ে নেওয়া খাবারটি পেট থেকে বের করার প্রচেষ্টায় নিজের প্রতি ক্ষতিকর আচরণ করেন, যেমন জোর করে বমি করা, ওজন কমার ওষুধগুলি ব্যবহার করা, মল এবং মূত্রবর্ধক ওষুধ নেওয়া, অতিরিক্ত ব্যায়াম এবং উপোস করা ইত্যাদি। ইদানীং ওজন কমানোর আকাঙ্ক্ষাতেও অনেকে এমন করছে।
বিঞ্জ ইটিং ডিসঅর্ডার: বিঞ্জ ইটিং ডিসঅর্ডার (Binge Eating Disorder), হলো অতিরিক্ত খাবার খেয়ে নেওয়া, অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে খাবার খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো। তবে এটি বুলিমিয়ার নয়, এইক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির খাওয়ার পরে কোনো মানসিক চাপ অনুভব করে না বা শরীর থেকে খাবার বের করে নেয়ার কোনো চেষ্টা ( যেমন বমি করা) করে না।
নেস: নাইট ইটিং সিন্ড্রোম (Night Eating Syndrome) মূলত যারা ইনসমোনিয়ায় আক্রান্ত, যাদের ঘুমের স্বাভাবিক স্লিপ সাইকেল ঠিক নেই, যারা অতিরিক্ত রাত জাগে; তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে দিনের যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করে।
কম্পালসিভ ওভার ইটিং: কম্পালসিভ ওভার ইটিং (Compulsive Overeating) অনেকটা বিঞ্জ ইটিং ডিসঅর্ডারের মতো, তবে এইক্ষেত্রে ক্ষুধার উদ্রেগ জাগাতে ইমোশন বা আবেগ কাজ করে। আক্রান্ত ব্যক্তি স্ট্রেস অনুভব করলে, নার্ভাস হয়ে গেলে, রেগে গেলে কিংবা গভীর মানসিক কষ্ট পেলে তা কাটাতে তার ক্ষুধার উদ্রেগ হয়। ফলে মানসিক শান্তি পেতে সে অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলে। এটি একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালে সারা বিশ্বে ৩.৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো সময়ে খাওয়ার সমস্যায় ভুগেছিলেন। ২০১৮ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৮ শতাংশে আর এই সময়টাতেই সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসার ঘটে।
টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে ইনফ্লুয়েন্সারদের ছড়ানো ভুল তথ্য কিশোরদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। ফলে কিশোরদের এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো চিকিৎসকদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুল তথ্যের এই বিভ্রান্তি চিকিৎসকদের কাজকে দুরূহ করে দিয়েছে।
ফ্রান্সের পুষ্টিবিদ ক্যারোল কপ্তি বলেন, ‘এখন কাউকে খাওয়ার সমস্যার চিকিৎসা দিতে গেলে, সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়েও আলোচনা করি। এটা রোগ শুরু করে, বাড়ায় ও ভালো হওয়ার পথে বাধা দেয়।’
খাদ্যাভ্যাস জনিত সমস্যার কারণ জটিল। এতে মানসিক, জিনগত, পরিবেশগত ও সামাজিক নানা কারণ কাজ করে। এসব কারণে যে কেউ এ সমস্যায় বেশি পড়তে পারে।
ফ্রান্সের স্টুডেন্ট হেলথ ফাউন্ডেশনের শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নাটালি গোডার্ট বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া চিকন হওয়া, কঠোর ডায়েট ও ঘন ঘন ব্যায়াম করাকে উৎসাহিত করছে। এতে করে আগে থেকেই দুর্বল মানসিকতার তরুণরা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং এটি তাদের স্বাস্থ্যগত হুমকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।’
বিপজ্জনক ট্রেন্ড
টিকটকে এখন জনপ্রিয় একটি হ্যাশট্যাগ হলো #স্কিনিটক। এই ট্রেন্ডে এমন সব পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যা বিপজ্জনক ও মানসিক চাপ তৈরি করে। এতে মানুষকে খুব কম খেতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে- যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
খাদ্য সমস্যায় বিশেষজ্ঞ ফ্রেঞ্চ নার্স শার্লিন বুইগ্ বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া এই সমস্যাগুলোর দরজা হিসেবে কাজ করছে। সেখানে এসব বিষয়কে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।’
তিনি এগুলোর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘অনেক অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত কিশোরী-তরুণীরা ভিডিওতে নিজের পুষ্টিহীন (চিকন) শরীর দেখাচ্ছে। আবার বুলিমিয়ায় আক্রান্তরা ভিডিওতে ইচ্ছা করে বমি করা দেখাচ্ছে।’
বুইগ্ বলেন, ‘ওজন কমানোর জন্য পায়খানা বাড়ানোর ওষুধ খাওয়া বা বমি করা সঠিক উপায় হিসেবে দেখানো হয়, অথচ এসব হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।’
খাদ্য সমস্যা হৃদরোগ তৈরি করে, সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমায় ও আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
গবেষণায় জানা গেছে, মানসিক রোগের মধ্যে অ্যানোরেক্সিয়ার মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
ফ্রান্সের স্বাস্থ্য বীমা সংস্থার তথ্য মতে, ১৫ বছর থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে অকাল মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো খাদ্যাভ্যাসের সমস্যা।
সোশ্যাল মিডিয়ার দুষ্টচক্র
ফ্রান্সের পুষ্টিবিদ ক্যারোল কপ্তি বলেন, ‘খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগে ভোগা অনেকেরই আত্মবিশ্বাস কম। কিন্তু অ্যানোরেক্সিয়ার কারণে শরীর অতিরিক্ত রোগা হয়ে যাওয়ার পর, তা সামাজিক মাধ্যমে দেখিয়ে যখন তারা লাইক, ভিউ ও ফলোয়ার পান, তখন সেটাই হয়ে ওঠে তাদের উৎসাহের উৎস। এতে সমস্যাটা আরও প্রকোট হয় আর নিজের অসুস্থতাকে অস্বীকার করার প্রবণতাও দীর্ঘস্থায়ী হয়।’
আরও বিপদ হয়, যখন এই কনটেন্ট থেকে টাকা আয় হয়। যেমন- এক তরুণী নিয়মিত টিকটকে নিজের বমি করার ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার করে টাকা পায়, আবার সেই টাকা দিয়ে খাবার কিনে খায়।
পুরোপুরি ব্রেনওয়াশড
ফ্রান্সের পুষ্টিবিদ ক্যারোল কপ্তি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া খাবারের অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠাকে আরও কঠিন, জটিল ও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ করে তোলে। কারণ তরুণরা অনলাইনে পাওয়া ভুল ডায়েট পরামর্শে বিশ্বাস করে।’
তিনি বলেন, ‘রোগীদের সঙ্গে পরামর্শের সময় তার মনে হয়, তিনি যেন কোনো বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি সেশনে আমাকে প্রমাণ করতে হয় যে, প্রতিদিন ১০০০ ক্যালোরি খাবার খাওয়া আমাদের শরীরের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এটা প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম আর পর্যাপ্ত খাবার না খাওয়াও অস্বাভাবিক।’
কপ্তি আরও বলেন, ‘রোগীরা একেবারে ব্রেনওয়াশড। রোগীদের সঙ্গে আমার সাপ্তাহিক ৪৫ মিনিটের সেশন থাকে। রোগীদের প্রতিদিন টিকটকে ঘণ্টাখানেক সময় কাটায়। ফলে তুলনামূলক আমার এই কম সময়ের সেশন তাদের সমস্যা সম্পূর্ণভাবে সমাধান করতে পারে না।’
ভুয়া ‘কোচ’দের দাপট
ফ্রান্সের শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নাটালি গোডার্ট বলেন, ‘অনেকেই এখন নিজেদের ডায়েট ‘কোচ’ বলে দাবি করছে। তারা ভুল, অযৌক্তিক আর অবৈধ তথ্য ছড়াচ্ছে। মানুষ তাদের কথায় বেশি বিশ্বাস করছে। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহজ কথা বলেও রোগীদের আস্থা পাচ্ছে না।’
নার্স বুইগ নিয়মিত নিজ উদ্যোগে ইনস্টাগ্রামে সমস্যাজনক কনটেন্টগুলোতে রিপোর্ট করেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় না। ভিডিও থাকে, অ্যাকাউন্টও বন্ধ হয় না। এটা খুবই হতাশাজনক।’
বুইগ আরও বলেন, ‘আমি আমার রোগীদের টিকটকসহ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলার পরামর্শ দিই। অনেকের কাছে এটি কঠিন মনে হলেও, এখন এটি ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।’
লুকানো বিপদ
যদিও সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু কন্টেন্ট প্রকাশ্যে ক্ষতিকারক, তবে এর অন্যান্য বিপদগুলি আরও সূক্ষ্ম। যেমন মনে করুন চরম ডায়েটিংয়ের টিপস বা কোমর সঙ্কুচিত করার লক্ষ্যে ওয়ার্কআউট রুটিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের রকভিলের ইটিং ডিসঅর্ডার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা জেনিফার রোলিন উল্লেখ করেছেন যে, ডায়েট সংস্কৃতির স্বাভাবিকীকরণ প্রায়শই সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক।
তিনি বলেন, ‘ওজন হ্রাস এবং শরীরের প্রতি আকৃষ্টতার উপর ফোকাস স্বাভাবিক করা হয়, যার ফলে অস্বাস্থ্যকর আচরণগুলি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।’
এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া ফিডগুলি যা শুধুমাত্র একটি শরীরের ধরণ প্রদর্শন করে তা ক্ষতিকারক হতে পারে, কারণ তারা শরীরের তুলনা এবং স্থিরকরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলে। রোলিন এই ফোকাস কমাতে বিভিন্ন ধরণের শরীরের ধরণ এবং ভ্রমণ বা শখের মতো অ-চিত্র-কেন্দ্রিক সামগ্রী দিয়ে নিজের খাবারকে বৈচিত্র্যময় করার পরামর্শ দেন।
যদিও সোশ্যাল মিডিয়া এই খাওয়ার ব্যাধির একমাত্র কারণ নয়, তবে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে এর প্রভাব উপেক্ষা করা উচিত নয়।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা অনবরত খাদ্য সংক্রান্ত পোস্ট, বিশেষ করে রাতে কিংবা এমন সময় যখন খাদ্য সংগ্রহ দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কষ্টসাধ্য, এগুলো এই ধরনের লোকেদের মাঝে আরও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।